আজিজুল সঞ্চয় :
মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) ভোর ৪টার একটু আগে হঠাৎ মোবাইল ফোনের রিংটোন বাজছে। একাধিকবার বাজার পর ফোন ধরলাম। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে খবর আসে কসবার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনার। ডিবিসি নিউজের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রতিনিধি সহকর্মী খন্দকার রায়হান ফোনে জানান দুই ট্রেনের সংঘর্ষের কথা। বললেন- বহু হতাহত আছে ভাই। দ্রুত খবর নেন। তার কাছে প্রশ্ন রাখলাম এখন কে ফোন ধরবে? তারপরও রায়হান ভাইয়ের কথায় ফোন করলাম আখাউড়া রেলওয়ে থানার ওসি শ্যামল কান্তি দাসকে। রিং হওয়া মাত্রই ফোন ধরলেন তিনি। তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল তিনি হাপাচ্ছেন! দুর্ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করে বললেন- ভাই ঘটনাস্থলে যাচ্ছি, হতাহত অনেক হতে পারে। এরপর ফোন করলাম জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার ডিআইও-১ ইমতিয়াজ আহম্মেদকে। তিনিও বহু হতাহতের আশঙ্কার কথা জানিয়ে উদয়ন এক্সপ্রেসে থাকা রেলওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তার ফোন নম্বর দিলেন। ফোন করে পরিচয় দিয়ে ইকবাল হোসেন নামে ওই কর্মকর্তার কাছে দুর্ঘটনার বর্ণনা জানতে চাইলাম। বললেন- লুপ লাইনে ঢোকার সময় উদয়ন এক্সপ্রেসকে ধাক্কা দেয় তূর্ণা নিশীথা। তিনি ঘটনাস্থলে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেন। আবার ফোন করলাম রেলওয়ের ওসি শ্যামল কান্তি দাসকে। এবার তিনি আটজনের মৃত্যুর কথা জানালেন। ফোনের সংযোগ কেটে ট্রেন দুর্ঘটনায় আটজনের মৃত্যুর সংবাদ লিখে ঢাকা অফিসে পাঠিয়ে আবার রায়হান ভাইকে ফোন করে বললাম ঘটনাস্থলে যেতে হবে। রায়হান ভাই বললেন- ভাই আমি মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হচ্ছি, আপনি অফিসের (ব্রাহ্মণবাড়িয়া অফিস) নিচে থাকেন। অন্ধকারের মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে। আমাদের সঙ্গে যমুনা টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি শফিকুল ইসলামও যুক্ত হন। অন্ধকার পথ ধরে এগোতে থাকে আমাদের মোটরসাইকেল। কিন্তু কুয়াশার কারণে মোটরসাইকেল চালাতে কষ্ট হচ্ছিল রায়হান ভাইয়ের। অর্ধেক রাস্তায় যাওয়ার পর স্পিড ব্রেকার দেখতে না পেয়ে আমরা নিজেরাই দুর্ঘটনার শিকার হতে নিচ্ছিলাম। যাই হোক ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে ভোরের আলো ফোটার পর আমরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম। সেখানে হাজারো উৎসুক জনতা দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেন দুটিকে ঘিরে রেখেছেন। উৎসুক জনতার কারণে উদ্ধার কাজেও ব্যাঘাত ঘটছিল। পুলিশ একটু পর পর বাশি বাজিয়ে মানুষকে সরানোর চেষ্টা করছিল। যাই হোক ঘটনাস্থলে গিয়ে চ্যানেল ২৪ এর ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ নিজস্ব প্রতিবেদক রিয়াজ উদ্দিন জামি, সহকর্মী সময় টিভির ব্যুরো প্রধান উজ্জল চক্রবর্তী, কালের কণ্ঠ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি বিশ্বজিৎ পাল বাবু, ৭১ টিভির জেলা প্রতিনিধি জালাল উদ্দিন রুমি, মাছরাঙা টিভির জেলা প্রতিনিধি আশেক মান্নান হিমেল, আরটিভির জেলা প্রতিনিধি আজিজুর রহমান পায়েল ও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর জেলা প্রতিনিধি মেহেদী নূর পরশসহ আরও কয়েকজন সহকর্মীর দেখা পাই। আমরা তিনজন একসঙ্গে গেলেও ঘটনাস্থলে গিয়ে আমি, শফিক ভাই ও রায়হান ভাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। যে যার মতো করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। খুঁজতে থাকলাম ভিন্নধর্মী কিছু স্টোরির ‘খোরাক’। এর মধ্যেই কান্ট্রি ডেস্ক থেকে ফোন এলো ভালো কিছু ছবি পাঠানোর জন্য। দ্রুত কয়েকটি ছবি তুলে ফেললাম। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয়া ছবি অফিসে পাঠানোর সময়। ইন্টারনেটের স্পিড কম থাকায় ছবি যেতে অনেক্ষণ সময় নিল। যাই হোক ছবি পাঠিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত দুই ট্রেনের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। এর মধ্যে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান জানালেন মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৫ জন হয়েছে। অফিসে ফোন করে আপডেট জানিয়ে দিলাম। সকাল সোয়া ৮টার দিকে কান্ট্রি ডেস্ক থেকে রয়েল ভাই (রুহুল আমিন রয়েল) ফোন করলেন। বললেন- ট্রেনের যাত্রী, প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় যারা দুর্ঘটনায় হতাহতদের উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে একটা স্টোরি পাঠানোর জন্য। এর কিছুক্ষণ পরে জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান আমাদের (সংবাদকর্মী) জানালেন দুর্ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দ্রুত মুঠোফোনে তদন্ত কমিটি গঠনের সংবাদ লিখে অফিসে পাঠালাম। এরপর সহকর্মী বাবু ভাই আর আমি স্টেশন মাস্টার জাকের হোসেন চৌধুরীর কাছে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য। দুর্ঘটনার কারণ এবং তার কোনো ভুল ছিল কি-না জানতে চাইলাম। তার বক্তব্য দিয়ে একটি সংবাদ লিখে অফিসে পাঠালাম।বাবু ভাই সংবাদ না লিখে অফিসের ডেস্কে ফোনে সব তথ্য জানিয়ে দিচ্ছিলেন তারা যেন সংবাদ লিখে নেন। অন্য সহকর্মীরাও অফিসে সংবাদ পাঠানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদকর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন লাইভ-ফোনো লাইভ নিয়ে। আর চিত্রসাংবাদিকরা ভিডিও ফুটেজ ধারণে তৎপর হয়ে ওঠেন। সকালের নাস্তা নিয়ে কারোরই কোনো চিন্তা ছিল না। কেননা প্রত্যেককেই তাদের নিজ নিজ অফিস থেকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছিল। পরে স্টেশন থেকে মিনিট দশেক হেঁটে চলে গেলাম বায়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মরদেহগুলো সেখানেই রাখা হচ্ছিল। সেখান থেকে স্টোরি পাঠালাম। রয়েল ভাই আবার ফোন করে বললেন দুর্ঘটনাস্থলে না থেকে হাসপাতালে গিয়ে আহত রোগীদের সাথে কথা বলে স্টোরি পাঠানোর জন্য। এবার আমি কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললাম- ভাই আমাকে একটু সময় দেন। আমি আপনাদের কাজটাই করছি। বেলা ১১ বাজছে অথচ এখনও পর্যন্ত আমি এক গ্লাস পানিও খাইনি। জবাবে রয়েল ভাই বললেন- কিছু খেয়ে তারপর কাজ করার জন্য। কিন্তু খাওয়া আর হলো না। রেলপথমন্ত্রীর দুর্ঘনাস্থল পরিদর্শনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য আবার ছুটে গেলাম স্টেশনে। কিন্তু মন্ত্রীকে আর পাইনি। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে চলে গেছেন। এর মধ্যে মোবাইল ফোনের চার্জও শেষ। সঙ্গে থাকা পাওয়ার ব্যাংকের চার্জও ফুরিয়ে গেছে। এবার স্টেশনের পাশে একটি বাড়িতে গিয়ে ফোন চার্জে লাগিয়ে সহকর্মী পরশের কাছ থেকে মন্ত্রীর বক্তব্যের অডিও রেকর্ড শুনে সংবাদ লিখলাম। সংবাদটি পাঠানোর পর নাস্তা না করে আবার গেলাম বায়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অবশ্য নিজ নিজ অফিসে সংবাদ পাঠানোর তাড়ায় অনেকেই নাস্তা