Wednesday, November 29, 2023
Home > জাতীয় সংবাদ > ঢাকার চেয়ে গ্রামে ঝুঁকি বেশি

ঢাকার চেয়ে গ্রামে ঝুঁকি বেশি

এপিপি বাংলা : দেশে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন। আমাদের হাতে যা তথ্য আছে, তার ওপর ভিত্তি করে এ মুহূর্তে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে ৮ ও ৯ এপ্রিল আইইডিসিআর যে তথ্য দিয়েছে তাতে সামান্য কিছু আন্দাজ করা যায়। ৮ এপ্রিল ঢাকা শহরে কোভিড-১৯ পজিটিভের সংখ্যা ছিল ৩৯ আর ৯ এপ্রিল সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ অর্থাৎ ১.৫৮ গুণ বেড়েছে। আর ৮ এপ্রিল ঢাকার বাইরে কোভিড-১৯ পজিটিভের সংখ্যা ছিল ১৫, আর ৯ এপ্রিল সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ৫০ অর্থাৎ ৩.৩ গুণ। এতে প্রতীয়মান হয়, কোভিড-১৯ সংক্রমণে ঢাকা শহরের চেয়ে ঢাকার বাইরে বাংলাদেশে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। তবে এখনই এ সম্বন্ধে মন্তব্য করা উচিত হবে না। যেভাবে নমুনা সংগ্রহ চলছে, যেভাবে টেস্ট হচ্ছে, তাতে অন্তত আরও ১৫ দিনের ফলাফল হাতে এলে খানিকটা প্যাটার্ন বোঝা যাবে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে চীনের উহান শহরে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সম্বন্ধে বিশ্ব প্রথম জানতে পারে। পরবর্তী সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নভেল করোনাভাইরাসের নাম দেয় কোভিড-১৯ অর্থাৎ নভেল করোনাভাইরাস ডিজিজ-১৯। সঙ্গে সঙ্গে এ-ও জানা যায় যে, চীন কোভিড-১৯ এর বিস্তৃতি রোধকল্পে অভূতপূর্ব কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। গোটা উহান শহরটিকে সম্পূর্ণভাবে লকডাউন ঘোষণা করেছে। কোনো মানুষের বাসা থেকে বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া রাস্তায় গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। শুধু উহান শহর নয়, গোটা হুয়ে প্রদেশটি চীনের অন্যান্য প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে, ২০০২ সালে সার্সের প্রাদুর্ভাবের সময় চীন বিশ্বকে তথ্য দিতে বিলম্ব করায় আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছিল। তাই এবার প্রথম থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে কোভিড-১৯ এর তথ্য সরবরাহ ও সাহায্য প্রার্থনা করেছে। কোভিড-১৯ এর বিস্তৃতির গতি অতি দ্রুত কিন্তু মৃত্যুহার ২-৪ শতাংশ। প্রাথমিক পর্যায়ে কোভিড-১৯ এর বিস্তৃতির দ্রুততার বিষয়টি চীনের জানা ছিল তাই কিছু কিছু মহলে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। কোভিড-১৯ প্রধানত শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে। আক্রান্তদের যাদের বয়স বেশি ও যারা আগে থেকেই অন্য কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হার্টের অসুখ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে, কিডনি ও লিভার রোগী তারাই কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর শিকার। এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই।
কোভিড-১৯ একটি বিদেশি ব্যাধি। বিদেশ থেকে কোভিড-১৯ যেন বাংলাদেশে না আসতে পারে সেই প্রচেষ্টাই আমাদের দেশকে এর কবল থেকে বাঁচার প্রথম কৌশল। কোভিড-১৯ আমদের দেশে আসতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে। তাই বিদেশে থেকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যেন না আসতে পারে সেই ব্যবস্থা করাই আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। সেই লক্ষ্যে আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে বহিরাগত যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের এর মাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের শনাক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়।
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে উহান শহরে পড়াশোনারত আমাদের দেশি ছাত্রছাত্রীরা খুবই বিপাকে পড়ে। এ অবস্থায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে উহান থেকে ৩১২ জন ছাত্রকে ঢাকায় এনে বিমানবন্দর সংলগ্ন হাজী ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। কোভিড-১৯ এর ইনকিউবেশন পিরিয়ড (কোভিড-১৯ শরীরে প্রবেশ করার পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সময় পর্যন্ত)।
২-১৪ দিন হওয়ায় তাদের ১৪ দিন একটি হল ঘরে বিশেষ ব্যবস্থায় আবদ্ধ রাখা হয়। এদের কারও মধ্যে কোভিড-১৯ এর লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়ায় সবাইকে বাড়ি যেতে দেয়া হয়। এদের কারও মধ্যে কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা দিলে তাকে চিকিৎসা প্রদান করার ব্যবস্থা ছিল।
এরপর যারা বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এসেছেন তাদের বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং করে বাসায় যেতে দেয়া হয় ও বলা হয় তারা যেন হোম কোয়েরেন্টিনে থাকেন।
বিমানবন্দরে কোভিড-১৯ স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থার মধ্যে অনেক ঘাটতির কথা আমরা পত্রপত্রিকা ও টিভিতে দেখেছি। এ সময় ইতালি থেকে অনেক বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসেন এবং বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের নির্দেশ মোতাবেক হোম কোয়ারেন্টিনে যান। চীনে কোভিড-১৯ বিস্তৃতি প্রতিরোধে অভূতপূর্ব কঠোর পদক্ষেপে আমরা চমৎকৃত হয়েছি কিন্তু আমাদের বিমানবন্দরে সুষ্ঠু স্ক্রিনিং ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করতে পারিনি।
চীনের কোভিড-১৯ বিস্তৃতি রোধের ব্যবস্থা কঠোরতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও দেরি করে ফেলেছে। সেসব দেশে প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করার আগেই বিপুলসংখ্যক বহিরাগত বিশেষ করে চীনের পর্যটকরা সেসব দেশে প্রবেশ করেছে। সেসব দেশে রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্বের ভয়াবহ পরিণতি আমরা কিছুদিন ধরে দেখছি। ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে সারাবিশ্বের মানুষ হতবাক। এত প্রাচুর্য ও উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন দেশগুলোর এ দুরবস্থা কেন।
বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ার জন্য এবং পর্যটকের স্বল্পতার জন্য বাংলাদেশ প্রচুর সংখ্যক কোভিড-১৯ এর বাহক থেকে রক্ষা পেয়েছে। বিশ্বে কোভিড-১৯ সংক্রমণে পর্যটকের সংখ্য একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।
কোভিড-১৯ এর বিস্তৃতি রোধে বাংলাদেশ যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তা কার্যকর হবে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা কেন্দ্রীভূত থাকার জন্য যে অসুবিধা ছিল তা ধীরে ধীরে নিরসন হচ্ছে।
এখন সারা দেশে টারটিয়ারি লেভেলের অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রিয়াল টাইম পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন ঢাকায় আইইডিসিআর, আইপিএইচ, আইসিডিডিআরবি, আর্মড ফোর্সেস প্যাথ ল্যাব, শিশু ফাউন্ডেশন, বিএসএমএমইউ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সিলেট মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, খুলনা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল মেডিকেল কলেজ, চিটাগং ফৌজদারহাট প্রিভেনটিভ মেডিকেল ইন্সটিটিউট। এসব প্রতিষ্ঠানে নমুনা সংগ্রহ ও নমুনা প্রবাহে সুষ্ঠুভাবে সমন্বয় সাধন করতে হবে।
এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা ও চিকিৎসা একই প্রতিষ্ঠানেই হচ্ছে। এরূপ প্রতিষ্ঠান খুবই রোগীবান্ধব। এই মডেলে সব মেডিকেল কলেজের টেস্টের সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থা সন্নিবেশিত থাকলে ব্যবস্থাটি রোগীবান্ধব হবে এবং এটাই বাঞ্ছনীয়।
কোনো ব্যবস্থাই জনবান্ধব না হলে জনসাধারণের সহযোগিতা পাওয়া কঠিন। আবার কিছু কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষকে কঠোর হস্তে নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করতে হয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সে বিষয়ে ভালো ভূমিকা রাখছে। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অসাধারণ অবকাঠামোকে আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে সচেতন করতে পারিনি। পরে বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে সবাই সচেতন হয়েছে। তাই নমুনা সংগ্রহ করা ও টেস্ট করার ব্যবস্থা অনেক শক্তিশালী হয়েছে। সার্বক্ষণিক ব্যবস্থার সমন্বয় সাধন করতে পারলে এই কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করা যাবে।
কিছু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ স্থানকে লকডাউন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য স্থানীয়ভাবে স্থানগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে ঝুঁকিমুক্ত করা। না হলে এখান থেকে সারা দেশে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে যাবে। সারা দেশে মোটামুটি জনচলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সবই কোভিড-১৯ না ছড়ানোর স্বার্থে। আমাদের দেশে আর্থসামাজিক অবস্থায় নিুবিত্ত মানুষরা পড়েছে বিপাকে। এ ব্যাপারে সরকারি ব্যবস্থা প্রশংসনীয়। এ ব্যাপারে দুর্নীতিকে সরকারের উচ্চতম স্থান থেকে কঠোরভাবে হুশিয়ার করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও ব্যক্তিগত সাহায্যকারী যদিও আমাদের বিপুল দুস্থ মানুষের তুলনায় অপ্রতুল কিন্তু বিশেষভাবে প্রশংসার দাবিদার।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য আলাদা করে ১১২টি আইসিইউ প্রস্তুত আছে। যদিও এগুলোর অবস্থান সম্বন্ধে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। যদি সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে সঠিক সময়ে রোগীকে আইসিইউ সুবিধা দেয়া হয় তবে তাদের সন্তোষজনক চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হবে। কোভিড-১৯ এর স্পেশাল ড্রাগ নেই। যেসব রোগী অন্যান্য অসুখ থাকে তারা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে মৃত্যুহার বেশি হয়।
এ সময় যদি আইসিইউতে রেখে তাদের জীবন প্রলম্বিত করা যায় তবে রোগী তার আপন ইমিউন রেসপন্স দিয়ে শরীর থেকে কোভিড-১৯ ইলিমিনেট করে তাকে সুস্থ করে তুলতে পারবে। তাই আইসিইউ সুবিধা কোভিড-১৯ আক্রান্ত ক্রিটিক্যাল রোগীদের জন্য অপরিহার্য। সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে তা করতে পারলে আমরা বাংলাদেশ কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসার ব্যাপারে আশাবাদী। তবে ধীরে ধীরে আমাদের এই চিকিৎসা ব্যবস্থার আরও উন্নতি করতে হবে। ম্যানপাওয়ার ট্রেনিংয়ের ব্যাপারেই যা তথ্য পাওয়া গেছে তাতে চিকিৎসাক্ষেত্রে বিশেষ করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ক্রিটিক্যাল রোগীদের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে বলে আশা করি। আশা করি যেন বিলম্বে প্রস্তুতির গোলকধাঁধায় বাংলাদেশও না পড়ে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, ভাইরোলজি বিভাগ
সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *