আসন্ন বাজেটকে কেন্দ্র করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি এর কেন্দ্রিয় সভাপতি আ স ম রব এর অনলাইন সংবাদ সম্মেলন করে জেএসডির দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন।যা নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হল।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
আপনাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
করোনা ভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যেই যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে এবং আগামীতে ঘটতে যাচ্ছে তা পূরণ করা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন। করোনার কারণে আর্থিক খাতে আমরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি তা পুনরুদ্ধার করার চ্যালেঞ্জই আমাদের কাছে এখন বড়। করোনার কারণে দেশের প্রায় সব সেক্টরের উৎপাদন বন্ধ থাকায় আমদানি রপ্তানি খাতে বিরাট প্রভাব পড়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশের জন্য নয় করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা অতীতের যেকোনো দুর্যোগ এর চেয়ে বেশি। করোনা পুরো বিশ্বকে গ্রাস করেছে, আর্থিকভাবেও বিপর্যস্ত করেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ আশংকার দিক হচ্ছে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটও চরম আকার ধারণ করতে পারে।
করোনায় সৃষ্ট গত দুই মাসে বিপর্যস্ত অর্থনীতির কারণে আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বহু পরিবারের আয় কমেছে, সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এর হিসাবে করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাড়িয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে করোনার সময়ে ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। শুধু অতি ধনী ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের অবস্থান পরিবর্তন হয়নি। আয় বৈষম্য বেড়েছে অনেক।
বাংলাদেশ ছিলো উচ্চ ‘আয় বৈষম্যের’ দেশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর মতে বাংলাদেশ এখন বিপজ্জনক ‘আয় বৈষম্যের’ দেশে পরিণত হয়েছে। এই বিপদজ্জনক আয় বৈষম্য কমাতে না পারলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব চরম হুমকিতে পড়বে। বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোতে এবং জিডিপি নির্ভর পরিকল্পনায় মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া আয় বৈষম্য কমানো সম্ভব হবে না।
প্রিয় বন্ধুরা,
করোনা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রতিদিন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার বাড়ছে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে লন্ডভন্ড পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদেরকে অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে হবে। এই ভয়াবহ সঙ্কটে জাতীয় ঐক্য স্থাপন না করে সরকার আত্মম্ভরিতায় একলা চলো নীতি অনুসরণ করে সমগ্র জাতিকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
করোনায় আর্থসামাজিক খাতে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে ,কোন কোন খাত বেশি আক্রান্ত হয়েছে, কত কোটি মানুষ কর্ম হারিয়েছ আর কত কোটি মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে নেমে এসেছে সরকার তার চূড়ান্ত তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই বাজেট পেশ করছে।
বন্ধুরা, আমরা বহুদিন থেকেই বিদ্যমান বাজেট প্রণয়ন ও বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলে আসছি। সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের বেড়াজালে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় এবং প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রিক উন্নয়নের আখ্যান দাঁড় করিয়ে বাংলাদেশকে নতুন সংকটে ফেলেছে। ধনী গরিবের পার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কর্মসংস্থান নির্ভর,মানবিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাত উপেক্ষা করে তথাকথিত উন্নয়ন এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। মেগা প্রজেক্টের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতা এবং বিপদজ্জনক আয় বৈষম্য রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
সরকার তথ্য উপাত্ত এবং বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার ফলে বাস্তবায়নে বড় ঘাটতি দেখা দেয়।
প্রিয় বন্ধুরা,
এবারের বাজেট যেন গতানুগতিক না হয়,বাজেট হতে হবে গণমুখী।
বাজেটে স্বাস্থ্যখাত, কৃষিখাত ও শিক্ষাখাতে যেমন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প-কলকারখানা চালু এবং কয়েক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সহ গণমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে :
১, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ ও শিক্ষা খাতে বাজেট প্রণয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ২. জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিল গঠন করে সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রনসহ করোনা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। ৩. মেগা প্রজেক্ট সমূহের অপচয় বন্ধ করতে হবে। রেন্টাল পাওয়ারের ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে। ৪. ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। ৫. কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সহ কৃষি উন্নয়নের ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ৬. কর্মহীন মানুষদের কর্মসংস্থানের জন্য দ্রুত ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালু করতে হবে, এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। ৭. গার্মেন্টস সহ সকল শিল্প কলকারখানায় শ্রমিকদের চাকরি নিরাপত্তা ও জীবন সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ৮. অবকাঠামো নির্ভর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংকুচিত করতে হবে। ৯. সামাজিক সুরক্ষার আওতা আরো সম্প্রসারণ করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।১০. খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
সাংবাদিক বন্ধুরা, আমরা রাষ্ট্রীয় রাজনীতির কাঠামোগত সংস্কারের শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছি। প্রচলিত উপনিবেশিক শাসন কাঠামো দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া স্বাধীন রাষ্ট্রের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব নয়।
আমরাই একমাত্র দল যারা ৭২’এর সংবিধানের আমূল সংস্কার চেয়েছি। যেমন ১. জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন। ২. বাংলাদেশে ৯টি প্রদেশ গঠন, প্রাদেশিক সংসদ ও সরকার গঠন ৩. জাতীয় স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক কাউন্সিল গঠন ৪. কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প ,সামাজিক ব্যবসা চালু, ৫। উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গঠনসহ রাজনৈতিক দার্শনিক সিরাজুল আলম খানের ১৪ দফা ও আমাদের ১০ দফায় পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা উপস্থাপন করেছি।
বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তন করে পেশাজীবী, জ্ঞান-বিজ্ঞান- মেধারর অধিকারী ও প্রযুক্তিবিদদের অংশীদারিত্ব ভিত্তিক রাজনৈতিক মডেল বাঙালির তৃতীয় জাগরণের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে। যার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিশ্বের উচ্চতম জাতীয়তাবাদের সাথে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। এবারের করোনার ভয়াবহতায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের অনিবার্যতা প্রকট হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন অংশীদারিত্ব গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে যেকোনো সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। আসুন, আমরা সবাই বলে বাংলাদেশের উপনিবেশিক শাসন কাঠামো বাতিল করে স্বাধীন দেশের উপযোগী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের দিকে এগিয়ে যাই।
ধন্যবাদ।
আ স ম আবদুর রব
সভাপতি
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল -জেএসডি