শাজাহান সিরাজের সাথে আমার যত স্মৃতি’ যত আন্দোলন-সংগ্রামের ঘটনা, জীবন মৃত্যু লড়াইয়ে যেভাবে একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম তা কোন ভাষায় রূপান্তর করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
আমি আর শাজাহান সিরাজ কতকিছু প্রত্যক্ষ করেছি। পাকিস্তানী রাষ্ট্রকাঠামোকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নির্মাণের দীর্ঘ পথ যাত্রায় আমরা একে অপরের সহযাত্রী।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মাঝে থেকে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা,স্বাধীন রাষ্ট্রের চেতনা বুকের মাঝে লালন করা, সেই লক্ষ্যে ছাত্র যুবসমাজকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করা এবং সম্পৃক্ত করার উজ্জল প্রেরণায় আমরা দুজন ছিলাম একে অন্যের অংশীদার।
আমরা দুজন একই সাথে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অত্যাচার নিপীড়িত মানুষের ক্রন্দন হাহাকার প্রত্যক্ষ করেছি। বাঙালিকে কিভাবে নির্দয় ভাবে হত্যা করে পাকিস্তানিরা বিকৃত পেয়েছে আমরা আমরা তাও গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি।
হুলিয়া গ্রেপ্তার আত্মগোপন আন্দোলন রচনার কৌশল আমরা একসাথে নির্ধারণ করেছি। আমরা মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে হাজার জনতার সাথে বজ্রকন্ঠে শ্লোগান দিয়েছি ‘জয় বাংলা’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ পিন্ডি না ঢাকা ,ঢাকা ঢাকা।
ছাত্ররাজনীতিতে আমরা দুজনেই স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খানের নির্দেশের আওতায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। আমাদের রাজনীতির নেপথ্য নায়ক তিনি। সিরাজুল আলম খান আমাদের মত হাজার হাজার তরুণের মনে স্বাধীনতা স্বপ্ন বপন করে দিয়েছেন। তার দুর্জয় সাহস স্থির বুদ্ধি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আমাদের সকল কাজের প্রেরণা হয়ে ওঠে।
আমরা সিরাজুল আলম খান এর কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে বীরোচিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। তিনি আমাদের ঘৃণ্য স্বার্থপর নিষ্ঠুর রাষ্ট্র সম্পর্কে সুতীক্ষ্ণ ভাবে সচেতন করে তোলেন এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করেন ।
আমরা দুজন খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি বাঙালি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা। আরো প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিউক্লিয়াস বিএলএফ এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা।
আমরা আরো প্রত্যক্ষ করেছি নিউক্লিয়াসের পরিকল্পনা অনুযায়ী আন্দোলন সংগ্রাম। ৬ দফা ১১ দফার আন্দোলন ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’আমরা ছিলাম একে অপরের সহযোগি। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠনের অনেক মৌলিক কর্মকান্ডের সাথে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের।
সিরাজুল আলম খানের নির্দেশেই জাতীয় পতাকা জাতীয় সংগীত নির্বাচনে আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তাঁর নির্দেশে পতাকা উত্তোলন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করার আমাদের দুজনের সুযোগ হয়েছিল। নিউক্লিয়াসে জড়িত না থাকলেস্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বলতর ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যেতাম। নিউক্লিয়াস এর সাথে ছাত্রলীগ শ্রমিক লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর মাঝে আন্তঃসম্পর্ক কি ছিল তাও আমরা অনেকটা অনুধাবন করতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খানের মাঝে সম্পর্কের নৈকট্য, পরস্পরের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাসের উচ্চতাও আমরা জানতে পেরেছি। এসব আমাদের সৌভাগ্য।
১৯৭০ সালে শাজাহান সিরাজ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সভাপতি হয়েছিলেন আমার বন্ধু নুরে আলম সিদ্দিকী। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনের সূতিকাগার হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সারাদেশের আপামর জনগণ তাকিয়ে থাকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিকে। বাঙালি জাতির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাকসু অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সে লক্ষ্যে ছাত্রদের সরাসরি ভোটে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ভিপি হিসাবে নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে শাজাহান সিরাজের ছিল অপরিসীম ভূমিকা।
আজকে যে স্বাধীন দেশের আমরা নাগরিক ,সেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা পাঠ করেছিলেন শাজাহান সিরাজ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে–এই ছিল ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার এর প্রথম বাক্য। এই ইশতেহারে বলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক।
আমরা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ গ্রহণ করেছি। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রয়োজনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক গঠনেও আমরা একসাথে ছিলাম। একসাথে আন্দোলন-সংগ্রাম লড়াই করেছি। একসাথে কারাগারে জীবনের সোনালী দিন কাটিয়েছি।
মৃত্যু আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না, শাজাহান সিরাজ আমার আত্মার অংশ।
শাজাহান সিরাজ আবার দেখা হবে সেদিন অনেক কথা বলবো।