Tuesday, December 5, 2023
Home > জাতীয় সংবাদ > ঢাকায় শ্রিংলা, আজ সচিব পর্যায়ে বৈঠক

ঢাকায় শ্রিংলা, আজ সচিব পর্যায়ে বৈঠক

এপিপি বাংলা : দুই দিনের তাৎপর্যপূর্ণ এক সফরে ঢাকায় এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় একটি বিশেষ বিমানে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন, কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সহযোগিতা ও দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য বিষয় আলোচনায় স্থান পাবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। আজ বুধবার বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হবে।
গত মার্চ মাসে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ঢাকা এসেছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের অধিবাসী শ্রিংলা বাংলাদেশে এর আগে দেশটির হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পদোন্নতি পেয়ে গত জানুয়ারি মাসে তিনি পররাষ্ট্রসচিব হন। এটি তার বাংলাদেশে দ্বিতীয় সফর।
ঢাকার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, উপমহাদেশের রাজনৈতিক ডামাডোল, চীনের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্কোন্নয়ন, করোনার টিকার ট্রায়াল নিয়ে কোটি কোটি ডলারের বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ের টানাপড়েনের মধ্যে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের এই সফর তাৎপর্যপূর্ণ। সূত্র বলছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে। দু’দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ, পারস্পরিক যোগাযোগ সহজীকরণ, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী তৎপরতা কমিয়ে আনার মতো অনেক ইস্যুর সমাধান হয়েছে। দু’দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে একাধিক সফরও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টনসহ অনেক অর্থনৈতিক ইস্যুর সমাধান হয়নি। অর্থনৈতিক গতিশীলতা আনতে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে চীনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়েছে। বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পে চীন অর্থনৈতিক কারিগরি সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। চীনে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ঘোষণা দিয়েছে চীন।
এ ছাড়া সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করতে চায় বলে পাক প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন। এসব বিষয়ের ওপর ভারতের দৃষ্টি রয়েছে এবং তারা বাংলাদেশের সাথে কোনোভাবেই বন্ধুত্বের ঘাটতি চায় না বলেই মনে করে। কিন্তু বাংলাদেশ চায় ভারত ও চীনের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ গভীর সম্পর্ক বজায় রাখতে। এমন পরিস্থিতিতে এই সফরকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি চীনের সাথে ভারত উত্তর সীমান্তে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের নিবিড়তা চায় ভারত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিদ্যমান সম্পর্কগুলো ঝালাই করে নিতেই ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের এই আকস্মিক সফর।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, নন-ইস্যুগুলো অতিরঞ্জিত আকারে প্রকাশ হচ্ছে। সেটার কারণে পাবলিক পারসেপশনে একটি প্রভাবও পড়ছে। এগুলো আমরা নিশ্চয় দেখব। কারণ এটা ঠিক না।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের রাষ্ট্রদূতের দেখা করার বিষয় নিয়ে একটি খবর ছাপা হয়েছে, যার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। প্রধানমন্ত্রী এই করোনা পরিস্থিতিতে কারো সাথে দেখা করছেন না। বিদেশীদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। তারপরও সোমবারে একটি নির্দেশনা পেয়েছি সেপ্টেম্বর থেকে বিষয়টি পুনরায় স্বাভাবিক করার জন্য। যতগুলো দেশের রাষ্ট্রদূতদের দেখা করার অনুরোধ জমে রয়েছে তাদের সবার সাথে আস্তে আস্তে প্রধানমন্ত্রী দেখা করবেন।
এতে সেপ্টেম্বরে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের যাওয়ার সময় চলে আসবে জানিয়ে সচিব বলেন, বিদায়ী সাক্ষাৎ তারা চেয়েছেন এবং সেটি হয়ে যাবে। এর সাথে অন্যান্য যাদেরটা জমে আছে তারাও দেখা পাবেন। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি সেপ্টেম্বরের পরে স্বাভাবিক হবে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূত দেখা করতে পারছেন না এটি একটি নন-ইস্যু এবং এই বিষয়টি বড় আকারে দেখা দিয়েছে। এগুলো একদম আমলে নেয়া ঠিক হবে না। দেশের গণমাধ্যম স্বাধীন এবং তারা তাদের মতো লিখছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছু নিউজ পোর্টাল, বিশেষ করে ভারতের কিছু পোর্টাল বানোয়াট খবর ছাপাচ্ছে। সেখানে কিছু ছবি ছাপা হয়েছে যেগুলো ফটোশপ করা।
এই বিষয়টি দুই সচিবের বৈঠকে উঠবে কিনা জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, আমরা যেটি চাচ্ছি তাদের কর্তৃপক্ষ যেন বিষয়টি দেখে। আমরা হয়তো আলোচনার মধ্যে এটি রাখতে পারি। কারণ আমরা চাইব দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে এ ধরনের ডিসট্র্যাকশন যেন না হয়।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ এবং এটি যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় জানিয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, অনেক ভালো কাজ হয়েছে। ট্রান্সশিপমেন্ট, ট্রেনে কার্গো চলাচল হচ্ছে। অনেক বাংলাদেশী আটকে ছিল এবং তাদের ফেরত আনা হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে প্রকল্পগুলোও বসে নাই।
উপমহাদেশে একটি অস্থিরতা আছে এবং এটি বৈশ্বিক অস্থিরতার একটি অংশ জানিয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বিরোধ বা ভারতের সাথে চীনের সাম্প্রতিক ঝামেলা- এই বিষয়গুলো কিভাবে আসবে আমি জানি না। তবে আলোচনা হতে পারে। এই বিষয়গুলো আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো ডিসট্র্যাকশন হিসেবে কাজ করবে না, এটি আমরা চাই। ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক অনেক গভীর এবং একই সাথে চীনের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব রয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, একটার সাথে আরেকটাকে গুলিয়ে ফেলাটা ঠিক হবে না।
সব দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক আছে এবং প্রতিটি দেশের সাথে সম্পর্কের মাত্রা ভিন্ন উল্লেখ করে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ভারতের সম্পর্কের সাথে চীনের সম্পর্ককে তুলনা করাটা সেটি ঠিক হবে না। অঙ্কের হিসাবে হয়তো বলবেন চীনের সাথে বাণিজ্য বেশি হয়েছে এবং ভারতের সাথে কম হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এত সহজভাবে দেখাটা ঠিক হবে না।
হঠাৎ করে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব কেন আসছেন জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক বিভিন্ন মুখী এবং এখানে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সফর হতে পারে এবং অতীতেও হয়েছে।
কোভিড না থাকলে এবং সময়টা স্বাভাবিক হলে আমাদের ভারতে একাধিকবার যাওয়া হতো জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব প্রায় ছয় মাস আগে এসেছেন এবং এর মধ্যে স্বাভাবিক ক্ষেত্রে তার দ্বিতীয়বার আসার সময় হয়ে গেছে। করোনার কারণে সবকিছু এলামেলো হয়ে গেছে। কোভিড একটি বড় ইস্যু এবং এখানে সহযোগিতার বিষয় আছে। চীন, রাশিয়া, আমেরিকা ও অক্সফোর্ড কোভিড-১৯ টীকা নিয়ে গবেষণা করছে এবং এর মধ্যে অক্সফোর্ডের বিষয়টি দেখছে ভারতীয়রা এবং তারা ট্রায়াল করছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘ভারতীয় ওষুধ কোম্পানি টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত এবং এ বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এমনও হতে পারে আমাদের দেশে এই টিকা বানানো যেতে পারে।
ভারত থেকে অনেক টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে অনেক মানুষের ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে চিকিৎসার কারণে অনেক লোক যায় এবং তারা এখন যেতে পারছে না।’
সরকারের কাছে অনেক ধরনের অনুরোধ আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এই ইস্যুটি অবশ্যই তুলব। আমরা যেমন প্রয়োজন অনুযায়ী লোক আসতে দিচ্ছি তারাও যেন আমাদের লোক আস্তে আস্তে যেতে দেয়।’
ভারতের জাতীয় নিবন্ধন বা নাগরিকত্ব আইনের মতো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মনে হয় না এই সফরে আলোচনা হবে। ওদের পক্ষ থেকে যদি কোনো আপডেট থাকে বা রি-অ্যাসুরেন্স থাকে তবে আমরা সেটি অবশ্যই শুনতে চাইব, তবে এটি নিয়ে আলোচনা করা বা মীমাংসা হওয়ার মতো বিষয় এখানে থাকবে না।’
গতকাল রাত ৮টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে গণভবনে সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিদায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলিও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দু’দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়। বৈঠকের আলোচনার বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *